উলিপুরে চায়না ডারকি জালের ফাঁদে বিলুপ্তি নদ-নদীর মৎস্য সম্পদ
আব্দুল মালেক,উলিপুর
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ব্রহ্মপুত্র নদে অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করা চায়নার ডারকি জালের ফাঁদ পেতে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতের মাছ নিধন শুরু হয়েছে। অবৈধ ওই জাল দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু জেলেরা মা মাছ নিধন করলেও মৎস্য বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারী নেই। অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীরা নদীতে অবাধে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় চলতি বছরেই দেশীয় মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির আশঙ্খা করছে অনেকেই।
চায়না জাল বা ডারকি জাল সম্পর্কে ওই এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চীন দেশের লোকজন তাদের ক্ষেত খামারে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড় নিধনের জন্য এ জাল তৈরি করে। ১ থেকে দেড় ফুট প্রস্থ, ৪০ থেকে ৫০ ফুট দৈর্ঘের ক্ষুদ্র ফাঁসবিশিষ্ট এই জাল। লোহা রিং দিয়ে ঢোলক আকৃতি ও মাঝে মাঝে চর্তুভূজ আকারের লোহা দিয়ে তৈরি এই বিশেষ ফাঁদ। একটি করে জালে ৪০-৫০টি করে খোপ আছে। বিশেষ কৌশলে এই জালের দুই মাথা খুটির সাথে বেঁধে পেতে রাখে খাল-বিল,নদী-নালা ও জলাশয়ের তলদেশ দিয়ে। জালের কাঠামোতে লোহার থাকায় জালটি পানির তলদেশে পৌঁছায়। এই জাল ক্ষুদ্র ফাঁসের কারণে সেই পথ ধরে ছোট থেকে যে কোন ধরণের বড় মাছ চলাচল করলে অনায়াসে জালের ভিতরে প্রবেশ করবে।এইসব জালের ফাঁদে যে কোন মাছ প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। এ জালে আটকা পড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতের মাছ। এমন ছোট পোনাও আটকা পড়ে যা কোন কাজে লাগে না বলে সেগুলো ফেলে দেন। এ ডারকি জাল কিছু অসাদু ব্যক্তি ডিমওয়ালা মা এবং পোনা মাছ অবাধে নিধন করছে। অবৈধ জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাছের স্বাভাবিক প্রজনন,বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাবে নদ-নদীতে মাছের প্রাচুর্য কমে গেছে। অচিরেই এসব জাল বন্ধ না হলে দেশের মৎস্য ভান্ডারে বিপর্যয় নেমে আসার শংকা স্থানীয়দের।
সরেজমিনে উপজেলার হাতিয়া ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অসংখ্য চায়না জাল বা ডারকি জাল দিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে ওই এলাকায় প্রতিটি মাছ ধরা নৌকার জেলের কাছে ২৫-৩০টি করে এই জাল আছে।
সুমন ও মনোরঞ্জন দাস বলেন, হামার বাপ দাদাদের হাত ধরে মাছ ব্যবসায় এসেছি। মাছ ধরাই আমাদের প্রধান পেশা। স্থানীয়ভাবে আমাদের মাঝি বলে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সারাদিন নদী থেকে যা মাছ পেতাম তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চলত। এখন আর ডারকি জালের জন্য মাছ পাওয়া যায় না। যারা কখনও মাছ ব্যবসায় আসেনি এখন তারাও ডারকি জাল নদীতে ফেলে রাখে। আর ওইসব জায়গায় আমরা জাল ফেলতে পারি না। এ নিয়ে বিভিন্ন জনের মাঝে মধ্যে সাথে ঝগড়া ঝাটিও হয়। অপেশাদার অনেকে ডারকি জাল নদীতে ফেলে রাখে,আগের মত মাছও পাই না আয়ও হয় না। শুধু সুমন দাস আর মনোরঞ্জন নয় উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের মাঝি পাড়া গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক মৎস্যজীবি মানুষ চরম দুর্দিনে পড়েছেন।
হাতিয়া ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের জেলে স্বদেশ চন্দ্র বলেন,সরকার চায়না বা ডারকি জাল নিষিদ্ধ করছে কিনা জানি না। এই জাল দিয়ে সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে। এই জাল গুলো ঢাকাতে পাওয়া যায়। বিকাশ। বিকাশে করে টাকা পাঠালেও জাল পাঠিয়ে দেয়। প্রায় ৫২ হাত লম্বা ডারকি জাল ৬ টি কিনেছি ২৬ হাজার টাকায়। মাছের ক্ষতি হলেও জাল কেনার টাকা তুলতে এবং পরিবারকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই এই জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন।
একই এলাকার জেলে শ্রী রাম চন্দ্র দাস বলেন,আমি ৪০বছর ধরে মাছ শিকার করছি। কিন্তু এবছরের ন্যায় মাছের সংকট আগে দেখিনি।
সরকার পাড়া গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল মুন্সি বলেন,মাছের চরম শত্রæ হলো ডারকি ও খ্যাতা জাল। এই জালে পোনাসহ সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে। অবৈধ জাল দিয়ে দিনে রাতে মাছ ধরলেও প্রশাসন খোঁজ রাখে না। শুধু সরকার ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা দিলে তখন একটু আসে এছাড়াও বছরের অন্য সময় তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সরকার যদি এসব জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ না করে তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কুড়িগ্রামে দেশীয় মাছের দেখা পাওয়া যাবে না।
এদিকে,উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী আছর উদ্দিন বলেন,আমি ২৫ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করেই সংসার চালাই। দীর্ঘদিনের এই ব্যবসায় এবারের মতো মাছ সংকটে আমি পড়ি নাই। এবারে মাছ সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন,নদীতে পানি কম আর অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় পোনাসহ ডিমওয়ালা মাছ কমে যাওয়া এমন সংকট দেখা দিচ্ছে।
হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন বলেন, চীন থেকে আমদানী করা ডারকি জাল, স্থানীয় কারেন্ট, ফাঁসি জাল এগুলো দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছে জেলে ছাড়াও অজেলেরা। ফলে দিনে দিনে বহুজাতের মাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি এখনই কার্যকরি পদক্ষেপ না নেয়,তবে আগামী প্রজন্ম মাছ কাগজ-কলমে দেখবে বাস্তবে নয়।
এই বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারিফুর রহমান সরকার বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অবৈধ এসব জাল দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন। লকডাউন শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন তিনি।