Uncategorizedরংপুরস্থানীয়

ভুয়া বিল-ভাউচারে বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ

স্টাফ রিপোর্টার,রংপুর:-

করোনা মোকাবেলায় বিশেষ প্রস্তুতি সম্পন্নসহ বিভিন্ন কাজে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারিভাবে ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের টাকা প্রচারণা, ক্যাম্পেইন, ব্যানার, আপ্যায়ন ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরির মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আরশাদ হোসেন।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বদরগঞ্জের শাহ্পুর হোটেল, রুপম হাউজ, ঢাকা আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক ও স্টাফদের থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন খাতে ভুয়া বিল-ভাউচার করা হয়। বাস্তবে এসব নামে বদরগঞ্জে কোন আবাসিক হোটেলের অস্তিত্ব নেই।

বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হলে তাদের ম্যানেজ করতে গ্রেড অনুপাতে এক হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ৭৫ তম জন্মদিন পালন উপলক্ষে হাসপাতাল চত্ত্বরে ৭৫টি ঔষধি ও ভেষজ চারা রোপনের জন্য তাকে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র দুটি গোলাপ ও একটি কড়াই গাছের চারা রোপন করে বরাদ্দের টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি গায়েবি বিল-ভাউচার দিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে দফায় দফায় লাখ লাখ টাকা নিজের পকেটে ভরেছেন। তিনি পিয়ন (অফিস সহায়ক) আলী হাসানকে ল্যাব টেকনিশিয়ানের পদে দায়িত্ব দিয়ে তার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি বরাদ্দের এসব টাকা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ডা. আরশাদ হোসেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদানের পর থেকে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অদক্ষতাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

৩০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিদর্শনের (মনিটরিং ও সুপারভিশন) জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি নতুন গাড়ী দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত কাজে গাড়ীটি ব্যবহার করে অফিস শেষে রংপুর শহরের বাসায় নিয়ে চলে যান।

এদিকে আরশাদ হোসেনের আস্থাভাজন অফিস পিয়ন আলী হাসানের সঙ্গে রয়েছে তার বিশেষ সখ্যতা। তার দাপটে অন্যান্য নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অনেকটাই কোনঠাসা। অফিস পিয়ন হলেও তিনি চলেন চিকিৎসকদের স্টাইলে। কাউকে তোয়াক্কা করেন না। আরশাদ হোসেনের নির্দেশে গত এক বছর ধরে প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন এই আলী হাসান।

অথচ প্যাথলজি বিভাগে আবু বক্কর সিদ্দিক নামে একজন কর্মরত থাকলেও তাকে দায়িত্ব বুঝে দেওয়া হচ্ছে না। এর আগে বদলী নেওয়া ল্যাব টেকনিশিয়ান আব্দুল জলিল প্যাথলজি বিভাগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রতি মাসে সরকারি কোষাগারে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা জমা দিতেন। অথচ আলী হাসান এক হাজার থেকে ১২’শ টাকাও জমা করেন না। গত তিন মাস থেকে তিনি কোন টাকাও জমা দেননি বলে দাবি করেন প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ফজলুল হক।

নমুনা ছবি (সংগৃহীত)

প্যাথলজি বিভাগে করোনার রেপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট, রোগির রক্তসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অর্থের সিংহভাগ টাকা যাচ্ছে ইউএইচএফপিও আরশাদ হোসেনের পকেটে বলে অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারি। সম্প্রতি আলী হাসানের মাধ্যমে ৭ হাজার টাকায় কেনা কম্পিউটার প্রিন্টার মেশিন ২৫ হাজার টাকার বিল ভাউচার করে জমা দেওয়া হয়। এছাড়া পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার টাকা বরাদ্দ থাকলেও গোটা হাসপাতাল চত্ত্বর যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।

এসব খাতের সিংহভাগ টাকা আলী হাসানের নামে চেক ইস্যু করে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন আরশাদ হোসেন। হাসপাতালে সরবরাহ করা করোনার কিটসহ অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী স্টোরকিপারের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করার নিয়ম থাকলেও এখানে তার বালাই নেই। আরও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে আরশাদ আলীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা পিয়ন আলী হাসানের বিরুদ্ধে। তিনি হাসপাতাল চত্ত্বরকে মাদকের আঁখড়ায় পরিণত করেছেন। যা নিজের মুখে স্বীকার করেন আরশাদ হোসেন।

এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে চলতি বছরের ১০ মে মোট ২ হাজার ৫০০ পিচ কিট (রেপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট) সরবরাহ করা হয়। যা ১০০ টাকা করে হলেও মুল্য দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অথচ আলী হাসান করোনা টেস্টের কিট বিক্রির মাত্র ৬০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। যার সিংহভাগ টাকা আলী হাসানের মাধ্যমে আত্মসাত করেন আরশাদ আলী।

এদিকে করোনার নমুনা সংগ্রহে জনপ্রতি ২০০ ও বাড়ি থেকে সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও হাসপাতালে রোগিদের রক্ত, মলমুত্রসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরো সুর্নিদিষ্ট ফি রয়েছে। এসব আদায়কৃত টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারের রোষাগারে জমা করার নিয়ম। কিন্তু এখানে তার কোন নির্দেশনা মানা হয় না। দিনের পর দিন আরশাদ হোসেন অফিস পিয়নের মাধ্যমে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা নয়ছয় করেছেন বলে জানা গেছে।

অভিযোগের বিষয়ে আলী হাসান বলেন, ‘পিয়ন পদে নই। আমি অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করি। তবে আমার প্যাথলজি বিভাগের ওপর তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করা আছে। এ কারণে ইউএইচএফপিও স্যার আমাকে ল্যাবের দায়িত্ব দিয়েছে। আরশাদ স্যারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে এটা ঠিক। তবে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নাই। আর মাদক সেবনের প্রশ্নই ওঠেনা বলে দাবি করেন তিনি।’
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্টোর কিপার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে ঔষধসহ সব ধরনের জিনিসপত্র সরবরাহ করা হলে আগে স্টোক রেজিস্ট্রারে তুলতে হবে। কিন্তু ইদানিং এসবের কোন নিয়ম নীতি মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ জিনিসপত্র আলী হাসানের মাধ্যমে জমা নেওয়া হয়। এ কারণে স্টোক রেজিস্ট্রার মেইনটেনেন্স করতে পারছি না।’

প্রধান হিসাব রক্ষক কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, ‘প্যাথলজি থেকে প্রাপ্ত টাকা প্রতি সপ্তাহে আমার মাধ্যমে ট্রেজারি চালানে ব্যাংকে জমা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু প্যাথলজি বিভাগের কোন টাকার হিসাব আমার কাছে দেওয়া হয় না। আলী হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর কোন টাকা কোথায় গেছে, তা আমার জানা নেই।’

ইউএইচএফপিও আরশাদ হোসেন বলেন, ‘সব হিসাব ক্যাশিয়ারের(হিসাব বিভাগ) কাছে থাকতে হবে এমন কোন কথাও নেই। করোনা মোকাবেলার জন্য ১৮ লাখ টাকা প্রচার, স্টাফ, আপ্যায়নসহ বিভিন্ন কাজে খরচ হয়েছে। তার বিল ভাউচার আছে। আমি হাসপাতালের এক টাকাও এপাশ-ওপাশ করিনি। আলী হাসানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন সখ্যতা নেই। তবে আলী হাসান মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত আছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি।’ 

রংপুর জেলা সিভিল সার্জন হিরম্ব কুমার রায় বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button